মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:১৯ অপরাহ্ন

ভয়াল রূপ নিচ্ছে ডেঙ্গু

ভয়াল রূপ নিচ্ছে ডেঙ্গু

স্বদেশ ডেস্ক:

দেশজুড়ে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে আক্রান্তের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এরই মধ্যে চলতি বছর দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত ৭৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। হাসপাতালে ভর্তি আছেন ২৩ হাজার ৫৯২ জন। তবে এ বছর মোট কতজন আক্রান্ত হয়েছেন, তার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং সামাজিকভাবে সচেতনতা না বাড়ালে বছরের বাকি দিনগুলোতে ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা আরও বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলতি বছর ডেঙ্গুর চারটি ধরনের মধ্যে তিনটির (স্ট্রেইন-১, ৩, ৪) প্রকোপ সুস্পষ্ট হয়েছে। ফলে সঠিক সময়ে চিকিৎসা না নিলে আক্রান্তের শক সিন্ড্রোম অর্থাৎ হঠাৎ শরীর নিস্তেজ হয়ে যাওয়া, হেমোরেজিক ফিবার বা অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ হওয়া, এমনকি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিকল হয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। এ ধরনের পরিস্থিতি রোগীকে মৃত্যুর দিকে ধাবিত করে। তাই এ সময়ে কারও শরীরে জ্বর দেখা দিলে দ্রুত পরীক্ষা করিয়ে হাসপাতালে ভর্তি বা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম বলেন, ডেঙ্গুতে বর্তমানে নারী ও শিশুরা আক্রান্ত বেশি হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে সব সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের সুচিকিৎসা নিশ্চিতের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মশা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নেই। এক্ষেত্রে সবাইকে আরও বেশি সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে ঘরের ভেতরে ও বাইরের পরিবেশ। ফুলের টব, বালতি বা ঘরের কোনো স্থানে পানি যেন না জমে থামে, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যে দেখা গেছে, চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়াদের ৪১ জনই ঢাকার। এ ছাড়া চট্টগ্রাম বিভাগে ২৭ ও কক্সবাজার জেলায় ২১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া বরিশাল বিভাগে মৃত্যু হয়েছে ৫ জনের। শুধু ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালেই ৭ জন করে ডেঙ্গু রোগী মারা গেছেন। মৃতদের মধ্যে ৬২ শতাংশের বয়স ২০ বছরে বেশি। তবে শূন্য থেকে এক বছর বয়সের অর্থাৎ শিশুদের মৃত্যু হয়েছে ৬ শতাংশ। এর মধ্যে ৪৮ শতাংশই হাসপাতালে ভর্তির তিন দিনের মধ্যে মারা গেছেন। মৃতদের ৪৬ জনই নারী। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যানে শক সিন্ড্রোম বা হেমোরেজিক ফিবারে আক্রান্ত হওয়ার কোনো তথ্য নেই।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকা শহরে সহস্রাধিক বেসরকারি হাসপাতাল থাকলেও মাত্র ৩৩টি বেসরকারি হাসপাতালের তথ্য প্রকাশ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এ ছাড়া ১৮টি সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীদের তথ্য প্রকাশ করা হয়। বাকি অসংখ্য হাসপাতালে তথ্য থেকে যায় স্বাস্থ্য বিভাগের অজানা। এতে দেশের ডেঙ্গু সংক্রমণের প্রকৃত তথ্য পাওয়া যায় না। ফলে সংক্রমণের প্রকৃত অবস্থ থেকে যায় অজানা এবং উদ্ভূত পরিস্থিতিতে করণীয় নির্ধারণে করা হয়ে ওঠে না।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার বলেন, আমরা ব্যর্থ হচ্ছি হটস্পট ব্যবস্থাপনায়। সে জন্য ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না। যেখান থেকে ডেঙ্গু রোগী বেশি আসে, সেখানে ক্রাস প্রোগ্রাম পরিচালনা করে উড়ন্ত মশাগুলোকে মেরে ফেলতে হবে। তা হলে এক রোগী থেকে অন্য রোগী আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে না।

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরীন জানান, কক্সবাজারে ডেঙ্গুর স্ট্রেইন ৩, ৪ ও ১-এর উপস্থিতি পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ ছোট দেশ। আজ ঢাকা, কাল কক্সবাজার, এভাবে মানুষের মুভমেন্ট হচ্ছে। ফলে ডেঙ্গুর সব ধরন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে। যদি কয়েকটি সেল টাইপ একসঙ্গে থাকে, তা হলে আক্রান্তের আশঙ্কা বেশি থাকে, সিভিয়ার ডেঙ্গু হওয়ার আশঙ্কাও দেখা দেয়। ২০১৩ সাল থেকে আইইডিসিআর ডেঙ্গুর সেল পর্যবেক্ষণ করছে। এ পর্যন্ত ভাইরাসের চারটি ধরন পাওয়া গেছে। ২০১৭ সাল পর্যন্ত আমাদের সার্কুলেশনে স্ট্রেইন-১ ও ২ ছিল। ২০২১ সালে স্ট্রেইন ৩-এর প্রকোপ দেখা দেয়। কিন্তু ২০২২ সালে স্ট্রেইন ৪-এর উপস্থিতি মিলেছে।

চলতি বছরে আক্রান্তের হিসাব : মাস হিসাবে আক্রান্ত ও মৃৃৃৃৃত্যুর তথ্যে দেখা যায়, জানুয়াি তে আক্রান্ত হয়েছে ১২৬ জন, ফেব্রুয়ারি ও মার্চে ২০ জন করে, এপ্রিলে ২৩, মে মাসে ১৬৩, জুন মাসে ৭৩৭, জুলাইয়ে ১৫৭১, আগস্টে ৩৫২১ এবং সেপ্টেম্বরে ৯৯১১ জন এবং অক্টোবরের ১১ দিনেই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৫৭৭৮ জন। চলতি বছরে প্রথম মৃত্যু হয়েছে জুন মাসে ১ জন, জুলাই মাসে ৯, আগস্ট মাসে ১১ এবং সেপ্টেম্বরে ৩৪ জন। এ ছাড়া চলতি অক্টোবরেই এখন পর্যন্ত এগারো দিনে মৃত্যু হয়েছে ১৯ জনের।

সতর্ক করা হয়েছে আগেই : গত আগস্ট মাসের ১১ থেকে ২৩ তারিখ পর্যন্ত ঢাকার দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে মৌসুমকালীন এডিস মশার জরিপ পরিচালিত হয়। এ সময়ে দক্ষিণ সিটির ৬২টি ওয়ার্ডকে ৯টি জোনে ভাগ করে ১৮৩০টি বাড়িতে জরিপ পরিচালিত হয়। যার মধ্যে ২১৫টি বাড়িতে মশার প্রজননক্ষেত্র পাওয়া যায়। একই সময়ে উত্তর সিটি করপোরেশনের ৪১টি ওয়ার্ড ১০টি জোনে ভাগ করে ১৩১৯টি বাড়িতে জরিপ পরিচালিত হয়। যার মধ্যে ২১৬টি খালি কনটেইনারে মশার প্রজননক্ষেত্র চিহ্নিত হয়। মৌসুমকালীন এডিস মশার জরিপে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ১৩.৪ শতাংশ বাড়িতে ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশার প্রজননস্থল পাওয়া যায়। যার মধ্যে লার্ভার ঘনত্ব (ব্রুট ইনডেক্স) ১৬.৩৮ শতাংশ। সর্বোচ্চ ঘনত্ব পাওয়া গেছে ১১, ১৪ ও ১৯ নম্বর ওয়ার্ডে ৩৬.৬ শতাংশ। এর মধ্যে ৫১.৪ শতাংশ বাড়ি বহুতল, ১৮.২ শতাংশ বাড়ি পৃথক, ১৩.১ শতাংশ বাড়ি নির্মাণাধীন, ১২.৬ শতাংশ বাড়ি সেমিপাকা এবং ৪.৬ শতাংশ ফাঁকা প্লট রয়েছে। এখানে সর্বোচ্চসংখ্যক লার্ভা পাওয়া গেছে জলমগ্ন মেঝেতে ১৮.৬ শতাংশ; প্লাস্টিক বাকাটে ১৫.২৮ শতাংশ এবং প্লাস্টিক ড্রামে ১০.১৯ শতাংশ।

মৌসুমকালীন এডিস মশার জরিপে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ১১.৭৫ শতাংশ বাড়িতে ডেঙ্গুর জীবাণুুবাহী এডিস মশার প্রজননস্থল পাওয়া গেছে। এর মধ্যে লার্ভার ঘনত্ব (ব্রুট ইনডেক্স) ১৪.১৫ শতাংশ। লার্ভার সর্বোচ্চ ঘনত্ব পাওয়া গেছে ৮ নম্বর ওয়ার্ডে ৫৩.৩ শতাংশ। এ ছাড়া ৩৮ ও ৪১নং ওয়ার্ডে এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব পাওয়া গেছে ৪০ শতাংশ। এর মধ্যে ৪৮.১ শতাংশ বাড়ি বহুতল, ২৪.৩ শতাংশ বাড়ি স্বতন্ত্র, ১০.৭ শতাংশ বাড়ি নির্মাণাধীন; ১১.৯ শতাংশ বাড়ি সেমিপাকা এবং ৪.৯ শতাংশ ফাঁকা প্লট রয়েছে। এখানে সর্বোচ্চসংখ্যক লার্ভা পাওয়া গেছে জলমগ্ন মেঝেতে ১৮.১৫ শতাংশ; প্লাস্টিক বাকাটে ১৩.৫১ শতাংশ এবং প্লাস্টিক ড্রামে ১৭.৩৭ শতাংশ। দক্ষিণ সিটিতে এডিস মশার সবচেয়ে বেশি আবাসস্থল পাওয়া গেছে বহুতল ভবনে ৩৩ শতাংশ, নির্মাণাধীন ভবনে ২২.৮ শতাংশ; স্বতন্ত্র বাড়িতে ২৭ শতাংশ, সেমিপাকা বাড়িতে ১২.১ শতাংশ এবং ফাঁকা প্লটে ৫.১ শতাংশ।

আরও ৩১০ জন হাসপাতালে : ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে আরও ৩১০ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে ঢাকায় ১৯৭ জন এবং ঢাকার বাইরে ১১৩ জন। গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের নিয়মিত ডেঙ্গুবিষয়ক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে, বর্তমানে দেশের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে মোট ২ হাজার ৭১৫ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। তাদের মধ্যে ঢাকার ৫১টি হাসপাতালে ১ হাজার ৯১৬ জন এবং অন্যান্য বিভাগে ১১৩ জন।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877